সোমপুর মহাবিহার, যা পাহাড়পুর বিহার নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের নওগাঁ জেলার বাদলগাছি উপজেলায় অবস্থিত একটি প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার। এটি বাংলার প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যশৈলীর একটি অনন্য নিদর্শন এবং ১৯৮৫ সালে ইউনেস্কো কর্তৃক বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। সোমপুর মহাবিহার বাংলার প্রাচীন ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং শিক্ষাগত কেন্দ্র হিসেবে বিবেচিত হয়।
সোমপুর মহাবিহারের ইতিহাস
সোমপুর মহাবিহার পাল সাম্রাজ্যের তৃতীয় রাজা ধর্মপাল (৭৮১-৮২১ খ্রিস্টাব্দ) কর্তৃক নির্মিত হয়েছিল। এটি ছিল প্রাচীন বাংলার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধ বিহারগুলির মধ্যে একটি এবং বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও প্রচারের জন্য ব্যবহৃত হত। বিহারটি মূলত একাধারে একটি ধর্মীয় কেন্দ্র, বিশ্ববিদ্যালয়, এবং শিক্ষাকেন্দ্র হিসেবে পরিচিত ছিল।
উল্লেখযোগ্য তথ্য
- প্রতিষ্ঠাতা: পাল রাজা ধর্মপাল
- নির্মাণকাল: ৮ম শতাব্দী
- অবস্থান: পাহাড়পুর, নওগাঁ, বাংলাদেশ
- বিশ্ব ঐতিহ্য: ইউনেস্কো কর্তৃক ১৯৮৫ সালে স্বীকৃত
স্থাপত্যশৈলী
সোমপুর মহাবিহারের স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন ভারতীয়, বিশেষত গন্ধার এবং গুপ্ত স্থাপত্যের প্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বিহারটি আয়তাকার আকৃতির এবং প্রায় ২৭০টি ছোট কক্ষ নিয়ে গঠিত, যা ভিক্ষুদের থাকার জন্য ব্যবহৃত হত। বিহারের কেন্দ্রস্থলে একটি বৃহৎ স্তূপ রয়েছে, যা প্রায় ৭০ ফুট উঁচু। স্তূপের চারপাশে একটি বাগান এবং ছোট ছোট মন্দির রয়েছে।
প্রধান আকর্ষণ
১. প্রধান স্তূপ: বিহারের কেন্দ্রে অবস্থিত প্রধান স্তূপটি সোমপুর মহাবিহারের প্রধান আকর্ষণ। এই স্তূপটি প্রায় ৭০ ফুট উঁচু এবং এর ভিত্তি চতুর্ভুজ আকারের। স্তূপের দেয়ালে বিভিন্ন প্রকারের খোদাই করা এবং মূর্তি রয়েছে, যা প্রাচীন বৌদ্ধ শিল্পের একটি নিদর্শন।
২. বিহারের চারপাশের কক্ষ: বিহারের চারপাশে মোট ২৭০টি ছোট কক্ষ রয়েছে, যা ভিক্ষুদের বসবাসের জন্য ব্যবহৃত হত। এই কক্ষগুলো বিহারের প্রধান ভবনকে ঘিরে রয়েছে এবং এগুলোতে প্রাচীনকালের স্থাপত্য এবং কারুকাজের নিদর্শন দেখা যায়।
- মন্দির ও বাগান: বিহারের চারপাশে ছোট ছোট মন্দির এবং বাগান রয়েছে, যা প্রাচীন কালের ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক জীবনের প্রতিচ্ছবি। এখানে বিভিন্ন ধরনের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শনও পাওয়া যায়, যা সোমপুর মহাবিহারের ইতিহাস এবং স্থাপত্য সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে।
সোমপুর মহাবিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব
সোমপুর মহাবিহার শুধুমাত্র একটি ধর্মীয় স্থান নয়, এটি প্রাচীন বাংলার শিক্ষা, সংস্কৃতি, এবং ধর্মীয় জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এখানে শিক্ষার্থীরা বৌদ্ধ ধর্মের বিভিন্ন শাখায় শিক্ষা গ্রহণ করত এবং বিহারটি বিভিন্ন দেশ থেকে আগত শিক্ষার্থীদের আকর্ষণ করত। বিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো পাল সাম্রাজ্যের সময়কার বৌদ্ধ স্থাপত্য, ধর্মীয় জীবন, এবং সাংস্কৃতিক বিকাশের সাক্ষ্য বহন করে।
কিভাবে পৌঁছাবেন?
ঢাকা থেকে সোমপুর মহাবিহারে পৌঁছানোর জন্য প্রথমে আপনাকে নওগাঁ জেলা শহরে যেতে হবে। ঢাকা থেকে নওগাঁ পর্যন্ত বাস, ট্রেন বা প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করে যাওয়া যায়। নওগাঁ শহর থেকে সোমপুর মহাবিহারের দূরত্ব প্রায় ৩০ কিলোমিটার, যা স্থানীয় যানবাহন ব্যবহার করে সহজেই পৌঁছানো যায়।
উল্লেখযোগ্য তথ্য: সোমপুর মহাবিহারে প্রবেশের জন্য একটি সামান্য প্রবেশ ফি রয়েছে। এটি প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে।
ভ্রমণের সময় যা মাথায় রাখা উচিত
১. পরিবেশ সংরক্ষণ: বিহারের প্রাকৃতিক এবং প্রত্নতাত্ত্বিক পরিবেশ সংরক্ষণ করা গুরুত্বপূর্ণ, তাই কোন প্রকার আবর্জনা না ফেলা এবং নিদর্শনগুলো স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
২. নিরাপত্তা: বিহারের বিভিন্ন স্থানে চলাচলের সময় সাবধানে চলা উচিত, বিশেষত উঁচু স্তূপ এবং সিঁড়ি ব্যবহারের সময়।
সোমপুর মহাবিহার বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যের একটি মহৎ নিদর্শন এবং এটি ইতিহাসপ্রেমী ও পর্যটকদের জন্য একটি অত্যন্ত আকর্ষণীয় গন্তব্য। এর সমৃদ্ধ ইতিহাস, স্থাপত্যশৈলী, এবং প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন একে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন আকর্ষণ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
No Comment! Be the first one.