মহাস্থানগড় বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যা বগুড়া জেলার শিবগঞ্জ উপজেলায় করতোয়া নদীর তীরে অবস্থিত। এটি বাংলার প্রাচীন সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন এবং পুন্ড্রবর্ধনের প্রাচীন রাজধানী পুন্ড্রনগরের ধ্বংসাবশেষ বলে মনে করা হয়। মহাস্থানগড় বাংলার ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং প্রত্নতত্ত্বে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান হিসেবে বিবেচিত হয়।
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস
মহাস্থানগড়ের ইতিহাস অত্যন্ত প্রাচীন এবং এটি খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দী থেকে শুরু হয়েছে বলে ধারণা করা হয়। এই স্থানের নাম ছিল পুন্ড্রনগর, যা ছিল প্রাচীন পুন্ড্রবর্ধনের রাজধানী। এটি মौर্য, গুপ্ত, পাল, এবং সেন আমলের গুরুত্বপূর্ণ শহর হিসেবে বিবেচিত হত। মহাস্থানগড়ের নাম মহাস্থানগড় হয়েছে মূলত সেখানকার একটি বড় দুর্গ বা গড়ের কারণে, যা শহরটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল।
উল্লেখযোগ্য তথ্য
- প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান হিসেবে আবিষ্কার: ১৮৭৯ খ্রিস্টাব্দে
- অবস্থান: শিবগঞ্জ, বগুড়া, বাংলাদেশ
- প্রাচীন নাম: পুন্ড্রনগর
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
মহাস্থানগড় একটি বিস্তীর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যেখানে অনেক প্রাচীন স্থাপনার ধ্বংসাবশেষ, মন্দির, স্তূপ, এবং অন্যান্য নিদর্শন রয়েছে। এই স্থানটি প্রত্নতত্ত্ববিদদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি বাংলার প্রাচীন ইতিহাস এবং সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের সাথে সম্পর্কিত।
১. গড় বা দুর্গ
মহাস্থানগড়ের প্রধান আকর্ষণ হলো এর বিশাল গড় বা দুর্গ, যা প্রায় ৪.৫ কিলোমিটার দীর্ঘ এবং ৩৬-৭০ মিটার প্রশস্ত। এই গড়ের দেয়ালগুলো ইটের তৈরি এবং এর মধ্যে বিভিন্ন ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়। গড়টি মূলত শহরটিকে সুরক্ষিত রাখার জন্য নির্মিত হয়েছিল।
২. মঈনামতির শিলালিপি
মহাস্থানগড়ে আবিষ্কৃত মঈনামতির শিলালিপি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। এই শিলালিপি গুপ্ত সাম্রাজ্যের সময়কার বলে ধারণা করা হয় এবং এতে বাংলার প্রাচীন রাজাদের শাসনকাল ও শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে বিবরণ রয়েছে।
৩. গোকুল মেধ ও বসু বিহার
মহাস্থানগড়ের আশেপাশে গোকুল মেধ এবং বসু বিহার নামে দুটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান রয়েছে, যেখানে প্রাচীন বৌদ্ধ বিহার এবং স্তূপের ধ্বংসাবশেষ পাওয়া গেছে। গোকুল মেধকে “বেহুলা-লখিন্দরের মেধ” নামেও ডাকা হয়, যা মৈমনসিংহ গীতিকার বিখ্যাত কাহিনীর সাথে সম্পর্কিত।
৪. জিয়ারত মহল ও দরিয়াপুর পণ্ডিতের ভিটা
মহাস্থানগড়ের অন্যতম উল্লেখযোগ্য স্থান হলো জিয়ারত মহল, যা একটি প্রাচীন মসজিদ এবং দরিয়াপুর পণ্ডিতের ভিটা নামে পরিচিত একটি প্রাচীন বসতি। এখানে আরও অনেক প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন পাওয়া যায়, যা প্রাচীন বাংলার সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক জীবন সম্পর্কে ধারণা প্রদান করে।
মহাস্থানগড়ের গুরুত্ব
মহাস্থানগড় বাংলার প্রাচীন ইতিহাস, ধর্ম, এবং সভ্যতার একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল। এখানে বিভিন্ন যুগের স্থাপনা এবং নিদর্শন পাওয়া যায়, যা প্রাচীন বাংলার ইতিহাস এবং সভ্যতা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করে। এটি শুধুমাত্র একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, এটি বাংলার ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়ের প্রতিফলন।
কিভাবে পৌঁছাবেন?
ঢাকা থেকে মহাস্থানগড় পৌঁছানোর জন্য প্রথমে আপনাকে বগুড়া যেতে হবে। ঢাকা থেকে বগুড়া পর্যন্ত বাস, ট্রেন, বা প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করে যাওয়া যায়। বগুড়া শহর থেকে মহাস্থানগড়ের দূরত্ব প্রায় ১৩ কিলোমিটার, যা স্থানীয় যানবাহন (রিকশা, সিএনজি) ব্যবহার করে সহজেই পৌঁছানো যায়।
উল্লেখযোগ্য তথ্য: মহাস্থানগড় প্রতিদিন দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত থাকে এবং এখানে প্রবেশের জন্য একটি সামান্য প্রবেশ ফি প্রযোজ্য।
ভ্রমণের সময় যা মাথায় রাখা উচিত
১. পরিস্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখা: প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে কোন প্রকার আবর্জনা না ফেলুন এবং স্থানগুলোর পবিত্রতা বজায় রাখুন।
২. নীরবতা বজায় রাখা: প্রত্নতাত্ত্বিক স্থানগুলোতে ভ্রমণের সময় নীরবতা বজায় রাখা উচিত, যাতে অন্যান্য দর্শনার্থীরা প্রদর্শনীগুলো ঠিকমতো উপভোগ করতে পারেন।
মহাস্থানগড় বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান, যা বাংলার প্রাচীন সভ্যতার উত্থান-পতনের সাক্ষ্য বহন করে। এর ধ্বংসাবশেষ, মন্দির, এবং শিলালিপি প্রাচীন বাংলার ইতিহাস ও সংস্কৃতির একটি সমৃদ্ধ অধ্যায়কে তুলে ধরে। ইতিহাসপ্রেমী এবং প্রত্নতত্ত্বে আগ্রহী যে কেউ মহাস্থানগড় ভ্রমণ করে বাংলার প্রাচীন ইতিহাসের সাথে সরাসরি পরিচিত হতে পারেন।
No Comment! Be the first one.