শালবন বিহার বাংলাদেশের অন্যতম প্রাচীন এবং গুরুত্বপূর্ণ বৌদ্ধবিহার, যা কুমিল্লা জেলার ময়নামতি অঞ্চলে অবস্থিত। এই বিহারটি প্রাচীন বাংলার সমৃদ্ধ বৌদ্ধ ঐতিহ্য এবং স্থাপত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন। শালবন বিহারের স্থাপত্যশৈলী, ইতিহাস, এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতি স্থানীয় এবং বিদেশি পর্যটকদের কাছে বিশেষ আকর্ষণীয়।
বিহারের ইতিহাস
শালবন বিহার প্রায় ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে পাল রাজবংশের সময় নির্মিত হয় বলে ধারণা করা হয়। এটি পাল রাজা ভবদেবের রাজত্বকালে নির্মিত হয়, যিনি বৌদ্ধ ধর্মের একজন পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বিহারটি মূলত একটি বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয় এবং ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহৃত হত, যেখানে ভিক্ষুরা ধর্মীয় শিক্ষা গ্রহণ করতেন এবং বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার ও প্রসার করতেন।
উল্লেখযোগ্য তথ্য
- প্রতিষ্ঠাকাল: ৮ম থেকে ১২শ শতাব্দীর মধ্যে।
- প্রত্নতাত্ত্বিক এলাকা: ময়নামতি, কুমিল্লা।
- উদ্ঘাটন: ১৯৫৫ সালে প্রত্নতাত্ত্বিক খননের মাধ্যমে এই বিহারের ধ্বংসাবশেষ উদ্ঘাটিত হয়।
স্থাপত্যশৈলী
শালবন বিহারের স্থাপত্যশৈলী প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ স্থাপত্যের অন্যতম উদাহরণ। এটি একটি আয়তাকার মঠের আকারে নির্মিত, যার চারপাশে ভিক্ষুদের থাকার কক্ষ এবং কেন্দ্রে একটি বৌদ্ধমন্দির রয়েছে। বিহারের প্রাচীরগুলো মজবুত ইটের তৈরি এবং এতে সূক্ষ্ম কারুকাজ খচিত। বিহারের মন্দিরের ভিতরে একটি বুদ্ধমূর্তি স্থাপিত ছিল, যা বর্তমানে বিহারের ধ্বংসাবশেষের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রধান আকর্ষণ
১. বিহারের মূল কাঠামো: শালবন বিহারের মূল কাঠামোটি একটি আয়তাকার ভবন, যার কেন্দ্রে একটি মন্দির এবং চারপাশে ভিক্ষুদের থাকার কক্ষ রয়েছে। এই মঠের মধ্যে ১১৫টি কক্ষ রয়েছে, যা ভিক্ষুদের ধ্যান এবং শিক্ষার জন্য ব্যবহৃত হত।
২. প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন: শালবন বিহার থেকে অনেক প্রাচীন বুদ্ধমূর্তি, তামার পাত্র, মৃৎপাত্র এবং অন্যান্য প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। এগুলো ময়নামতির প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে সংরক্ষিত রয়েছে।
৩. প্রাচীর এবং প্রবেশপথ: বিহারের প্রবেশপথে সুন্দর কারুকাজ এবং প্রাচীন স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শন দেখা যায়। প্রাচীরগুলো শক্তিশালী এবং মজবুত, যা বিহারের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা নির্দেশ করে।
প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্ব
শালবন বিহার বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এটি প্রাচীন বাংলার বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার এবং পাল সাম্রাজ্যের সময়কার ধর্মীয় সংস্কৃতির সাক্ষ্যবহন করে। শালবন বিহারের প্রত্নতাত্ত্বিক খনন থেকে প্রাপ্ত নিদর্শনগুলো পাল সাম্রাজ্যের সময়কার বৌদ্ধ স্থাপত্য এবং ধর্মীয় জীবনের মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে।
ভ্রমণ তথ্য
শালবন বিহার পরিদর্শন করতে চাইলে আপনি কুমিল্লা শহর থেকে সহজেই এখানে পৌঁছাতে পারেন। কুমিল্লা শহর থেকে শালবন বিহারের দূরত্ব প্রায় ৮ কিলোমিটার এবং সড়কপথে অল্প সময়েই পৌঁছানো যায়। বিহারটি প্রতিদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে। এখানে প্রবেশের জন্য একটি সামান্য প্রবেশমূল্য রয়েছে, যা স্থানীয় কর্তৃপক্ষ দ্বারা নির্ধারিত।
কিভাবে পৌঁছাবেন?
ঢাকা থেকে কুমিল্লা পৌঁছানোর জন্য আপনি বাস, ট্রেন বা প্রাইভেট গাড়ি ব্যবহার করতে পারেন। কুমিল্লা শহর থেকে শালবন বিহারে যাওয়ার জন্য রিকশা, সিএনজি বা স্থানীয় যানবাহন ব্যবহার করা যেতে পারে।
উল্লেখযোগ্য তথ্য: শালবন বিহার পরিদর্শনের সময় শালীন পোশাক পরিধান এবং বিহারের স্থাপনা সংরক্ষণের জন্য সচেতন থাকা প্রয়োজন।
শালবন বিহার বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ স্থাপত্যের একটি মহৎ নিদর্শন, যা প্রাচীন বাংলার ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক এবং স্থাপত্যশৈলীর সাক্ষ্য বহন করে। এটি শুধু একটি প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান নয়, বরং একটি ঐতিহাসিক শিক্ষা কেন্দ্র, যা বাংলার বৌদ্ধ ঐতিহ্যের মূল্যবান উপাদান।
No Comment! Be the first one.